আঞ্চলিক শক্তির আত্মপ্রকাশ |
আঞ্চলিক শক্তির আত্মপ্রকাশ
- [১] গুপ্ত রাজশক্তির অবক্ষয় ও পতন
সমুদ্রগুপ্ত, দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত ও স্কন্দগুপ্তের অক্লান্ত পরিশ্রম ও সামরিক প্রতিভার বলে মগধকে কেন্দ্র করে যে বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল, তা পঞ্চম শতকের শেষ ভাগ থেকে ভেঙে পড়তে থাকে এবং ষষ্ঠ শতকের মধ্যভাগে তার বিলুপ্তি ঘটে। মৌর্যযুগ থেকে মােগল যুগ পর্যন্ত ভারতীয় সাম্রাজ্যের পতনের যেসব সাধারণ কারণকে চিহ্নিত করা হয়েছে, গুপ্ত সাম্রাজ্যের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ছিল না—যেমন রাজপরিবারের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব, প্রাদেশিক অভ্যুত্থান, আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতাবাদের প্রবণতা, বিদেশি শত্রুর আক্রমণ, অর্থনৈতিক অবক্ষয় ইত্যাদি।
[১] রাজপরিবারে অন্তদ্বন্দ্ব ও দূর্বলতা : স্কন্দগুপ্তের মৃত্যুর পর গুপ্ত রাজপরিবারে তীব্র অর্ন্তদ্বন্দ্বের সূচনা হয়। স্কন্দগুপ্তের পরবর্তী সম্রাটরা সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রীয় ঐক্য বজায় রাখতে ব্যর্থ হন। তাদের অযােগ্যতা ও পরস্পর-প্রতিদ্বন্দ্বিতা গুপ্ত সাম্রাজ্যের সামরিক শক্তি যথেষ্ট পরিমাণে ক্ষুন্ন করে।
[২] আমলাতন্ত্রের অবক্ষয় : মৌর্য সাম্রজ্যের মতাে গুপ্ত সাম্রাজ্যের আমলাতন্ত্র সুসংগঠিত ও সুদক্ষ ছিল না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীদের (যেমন : মন্ত্রী, সচিব, আমত্য) বেতনের পরিবর্তে ভূমিদান করার প্রথা ছিল এবং তাদের পদ ছিল বংশানুক্রমিক। এই অবস্থায় আমলাতন্ত্রের দক্ষতা হ্রাস ও অবক্ষয় ছিল স্বাভাবিক ভবিতব্য।
[৩]স্থায়ী সেনাবাহিনীর অভাব : গুপ্ত সাম্রাজ্যের কোনাে স্থায়ী সেনাবাহিনী ছিল না। সেনাবাহিনী, রণহস্তি ও যুদ্ধের ঘােড়ার জন্য গুপ্ত সম্রাটদের সম্পূর্ণভাবে প্রাদেশিক শাসনকর্তা ও সামন্তদের ওপর নির্ভর করতে হত। সামন্তনির্ভর এই ধরনের সাম্রাজ্য দীর্ঘস্থায়ী হওয়া সম্ভব নয় এবং গুপ্ত সাম্রাজ্যের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল।
[৪] সামন্তদের শক্তি বৃদ্ধি ও ক্রমহ্রাসমান কেন্দ্রীয় শাসন কর্তৃত্ব : গুপ্তযুগের প্রথমদিকের শক্তিশালী এককেন্দ্রিক শাসনকাঠামাে পরবর্তীকালে ধীরে ধীরে সামন্তনির্ভর যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় রূপান্তরিত হয়। গুপ্তরাজাদের মধ্যে ব্রাত্মণদের ভূমিদান করা ছাড়াও উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীদের গ্রাম দান করার প্রথা ছিল। এর ফলে ধীরে ধীরে গুপ্ত সাম্রাজ্যের বহু অঞলের ওপর সম্রাটের কর্তৃত্বের পরিবর্তে প্রাদেশিক শাসনকর্তা ও সামন্তদের কর্তৃত্ব স্থাপিত হয়। গুপ্ত সাম্রাজ্যের শক্তিশালী সামন্ত রাজাদের মধ্যে কণৌজের মৌখরী বংশ, মান্দাশােরের যশােবর্মন ছিলেন উল্লেখযােগ্য।
[৫] বিদেশি আক্রমণ ও অর্থসংকট : বিদেশি আক্রমণ গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের প্রথম কারণ। প্রথম কুমারগুপ্ত ও স্কন্দগুপ্তের আমলে পুষ্যমিত্র ও হুণদের আক্রমণের ফলে সাম্রাজ্যের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। অনেকের মতে, হুণ আক্রমণ গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতন এর প্রধান কারণ। কিন্তু মনে রাখা দরকার যে, গুপ্তসম্রাটরা হুণ আক্রমণ সাফল্যের সঙ্গে মােকাবিলা করেছিলেন। তবে সেই সঙ্গে একথাও অনস্বীকার্য যে, বিদেশি শত্রুর ক্রমাগত আক্রমণের ফলে গুপ্ত সাম্রাজ্যে এক দারুণ অর্থনৈতিক সংকটের উদ্ভব হয় যা নিরসন করা সম্ভব হয়নি।
[৬] সামন্ত ও প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের স্বাধীনতা ঘােষণা : গুপ্ত রাজপরিবারের অন্তর্কলহ ও বিদেশি আক্রমণের ফলে যে গােলযােগের উদ্ভব হয়, তার পূর্ণ সুযােগ গ্রহণ করেন প্রাদেশিক শাসকরা ও সামন্তরা। মালবের যশােধর্মন, বলভীর মৈত্রক, কনৌজের মৌখরী প্রভৃতি সামন্তরা গুপ্ত সাম্রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীনতা ঘােষণা করেন। প্রাদেশিক শাসকরাও সেই সুযােগ গ্রহণ করেন। গুপ্তসম্রাটদের এমন শক্তি ছিল না যে, সামন্ত ও প্রাদেশিক শাসকদের দমন করে সাম্রাজ্যের অখণ্ডতা রক্ষা করতে পারেন।
[৭]পরবর্তী গুপ্ত সম্রাটদের যুদ্ধবিমুখতা : স্কন্দগুপ্তের পরবর্তী গুপ্তসম্রাটদের যুদ্ধ-বিমুখতা ছিল গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের অপর কারণ। পরবর্তী গুপ্ত সম্রাটদের অনেকেই (যেমন : বুধগুপ্ত, তথাগতগুপ্ত, বালাদিত্য প্রমুখ) বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করে স্বভাবতই যুদ্ধবিমুখ হয়ে পড়েন। সম্রাটদের এই যুদ্ধ-বিমুখতা মৌর্য সাম্রাজ্যের মতাে গুপ্ত সাম্রাজ্যের সামরিক শক্তিও যারপরনাই ক্ষুন্ন করে।
[৮] অর্থনৈতিক অবক্ষয় : গুপ্ত সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক অবক্ষয় এই সাম্রাজ্যের পতনের আর-এক কারণ। এই অবক্ষয়ের মূলে ছিল বাণিজ্যের সংকোচন। চতুর্থ ও পঞম শতকে বর্বরদের রােম আক্রমণের ফলে ভারত-রােম বাণিজ্যের অবনতি ঘটে এবং রােমে ভারতীয় পণ্যের আমদানি যথেষ্ট কমে যায়। আবার চিন রেশম তৈরির কৌশল আয়ত্ত করলে চিনে ভারতের রেশমের চাহিদা কমে যায়। অথচ সমৃদ্ধ বাণিজ্য ছিল গুপ্ত সাম্রাজ্যের আয়ের প্রধান উৎস। এছাড়া সামন্তরা স্বাধীনতা ঘােষণা করে সম্রাটকে দেয় কর বন্ধ করে দেন। সুতরাং, অর্থনৈতিক অবক্ষয় গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতন অনিবার্য করে তােলে।
[২] উত্তর ও দক্ষিণে আঞ্চলিক রাজশক্তির আত্মপ্রকাশ
- [ক] উত্তর-ভারত
ভূমিকা: গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর উত্তর ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে কয়েকটি স্বাধীন রাজ্যের অভ্যুত্থান ঘটে, যেমন : গান্ধার ও পাঞ্জাব থেকে মাল পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলে হুণরাজ্য, কনৌজ রাজ্য, মালব রাজ্য, গৌড় রাজ্য ইত্যাদি। গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের যুগে এইসব রাজ্যগুলি উত্তরভারতে প্রভুত্ব স্থাপনের জন্য পরস্পরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হয়।
[১] হুন রাজ্য
হিয়ং-নু বা হুণরা ছিল মধ্য এশিয়ার এক বর্বর জাতি। খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকে হুণরা গুপ্ত সাম্রাজ্য আক্রমণ করে। কিন্তু গুপ্তসম্রাট কুমারগুপ্তের পুত্র স্কন্দগুপ্ত তীব্র প্রতিরােধ গড়ে তুলে। কিছুদিনের জন্য গুপ্ত সাম্রাজ্য রক্ষা করেন। ষষ্ঠ শতকের প্রথমদিকে হুণ-নায়ক তােরমান এর নেতৃত্বে হুণরা পাঞ্জাব থেকে গুপ্ত সাম্রাজ্যের ওপর আক্রমণ চালিয়ে পশ্চিমের কিছু অঞ্চল দখল করে নেয়। তােরমানের মৃত্যুর পর তার অত্যাচারী পুত্র মিহিরকুল হুণ সিংহাসনে বসেন (আনুমানিক ৫১৫ খ্রিঃ)। কলহণ - এর রাজতরঙ্গিনী থেকে জানা যায় যে, মিহিরকুল ছিলেন অত্যন্ত পরাক্রান্ত রাজা এবং গান্ধার, কাশ্মীর ও দক্ষিণ ভারত তার সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তার নেতৃত্বে হুণ-প্রাধান্য গােয়ালিয়র পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। তিনি মধ্যভারতে রাজ্যবিস্তারে উদ্যোগী হলে মন্দাশােরের অধিপতি যশােধর্মনের কাছে পরাস্ত হন (৫৩৩ খ্রিঃ)। মিহিরকুলের মৃত্যুর পর যােগ্য নেতার অভাবে হুণ শক্তি ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত তারা ভারতীয় ধর্ম ও সংস্কৃতির ধারায় প্রভাবিত হয়ে রাজপুত জাতির সঙ্গে মিশে যায়।
[২] গৌড় রাজ্য
গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের সুযােগে যে কয়টি স্বাধীন রাজ্যের উত্থান ঘটে, বাংলার গৌড় ছিল তাদের মধ্যে অন্যতম। গৌড় রাজ্যের উৎপত্তি ও জনপ্রিয়তার নেপথ্যে ছিল শশাঙ্কের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব। আনুমানিক ৬০৬ খ্রিস্টাব্দে শশাঙ্ক গৌড়ে একটি স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। সিংহাসন লাভের পর শশাঙ্ক দক্ষিণ ও পূর্ববঙ্গ অধিকার করে সমস্ত বাংলায় তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। এমনকি তিনি কনৌজের মৌখরি বংশ এবং কামরূপরাজ ভাস্করবর্মাকে পরাজিত করেন। এছাড়া হর্ষবর্ধনকে পরাজিত করে শশাঙ্ক বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যায় নিজের আধিপত্য বজায় রাখতে সক্ষম হন।
সাম্রাজ্য বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে রাজ্যের শাসনব্যবস্থাকে উন্নত করে শশাঙ্ক নিজেকে একজন প্রজাহিতৈষী শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। ব্যক্তিগত জীবনে শশাঙ্ক শিবের উপাসক হলেও তিনি পরধর্মসহিষ্ণু ছিলেন। শশাঙ্কের সুদক্ষ নেতৃত্ব, পরাক্রম এবং ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলে অন্তত কিছুদিনের জন্য বাংলা একটি সর্বভারতীয় শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এই কারণে ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার শশাঙ্ককে 'বাঙালি রাজাদের মধ্যে সর্বপ্রথম সার্বভৌম নরপতি হিসাবে অভিহিত করেছেন।'
[৩] থানেশ্বরের পুষ্যভূতি বংশ
গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শক্তির অভাবে উত্তর ভারতে দীর্ঘকালব্যাপী অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা এবং রাজনৈতিক অনৈক্যের সৃষ্টি হয়। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে হর্ষবর্ধন তাঁর অসাধারণ রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি ও রণনীতির মাধ্যমে উত্তর-ভারতের রাজনৈতিক ঐক্য এবং অখণ্ডতা অনেকাংশে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হন।
• হর্ষবর্ধন : সভাকবি বাণভট্ট রচিত হর্ষচরিত হিউয়েন সাঙ-এর ভ্রমণ বৃত্তান্ত এবং নানান শিলালিপি থেকে হর্ষবর্ধনের রাজত্বকালের ইতিবৃত্ত জানা যায়। নানা কারণে ভারতের ইতিহাসে হর্ষবর্ধনের শাসনকাল ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
[১] রাজ্যবিস্তার :
• প্রথম পর্যায় : হর্ষবর্ধনের সিংহাসন লাভের পর কনৌজের অমাত্যদের অনুরােধে হর্ষবর্ধন প্রিয় ভগিনী রাজ্যশ্রীর পক্ষে কনৌজের শাসনভারও গ্রহণ করেন। হর্ষবর্ধনের এক বিশাল সেনাবাহিনী ছিল। গৌড়রাজ শশাঙ্কের মৃত্যুর পর তিনি মগধ, ওড়িশা ও বাংলা জয় করেন।
০ দ্বিতীয় পর্যায় : পূর্ব ভারতে রাজ্যজয়ের পর হর্ষবর্ধন পশ্চিমে সৌরাষ্ট্রের বলভী রাজ্য আক্রমণ করে সেখানকার রাজা ধ্রুবসেনকে পরাজিত করেন। বাণভট্টের মতে, হর্ষবর্ধন নেপাল ও কাশ্মীর জয় করেন। কিন্তু এ সম্পর্কে সঠিক কোনাে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না।
• তৃতীয় পর্যায় : পরবর্তী সময়ে হর্ষবর্ধন দক্ষিণ ভারতে রাজ্য বিস্তারে আগ্রহী হন। কিন্তু চালুক্য সম্রাট দ্বিতীয় পুলকেশীর কাছে পরাজিত হওয়ায় হর্ষবর্ধনকে দাক্ষিণাত্য বিজয়ের পরিকল্পনা ত্যাগ করতে হয়। অবশ্য হর্ষবর্ধনের রাজ্য বিস্তারের সাফল্য সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে।
হর্ষের প্রশস্তিকারকগণ তাকে ‘সকল উত্তরপথনাথ’ বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু সমগ্র উত্তর ভারতে হর্ষবর্ধনের প্রাধান্য স্থাপিত হয়েছিল কিনা তার সঠিক প্রমাণ নেই।
এই জন্যই ডঃ রমেশ চ্ন্দ্র মজুমদার তাঁকে উত্তর পথনাথ’ বলে স্বীকার করেন নি। এই প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক ডঃ হেমচন্দ্র রায় চৌধুরী বলেছেন, 'হর্ষবর্ধন সমুদ্রগুপ্তের সাম্রাজ্যের আদর্শে উত্তর ও দক্ষিণ ভারতকে এক রাজছত্রতলে আনার চেষ্টা করেন, তবে তা ফলপ্রসূ হয়নি।'
[২] হর্ষবর্ধনের শাসন ব্যবস্থা : হর্ষবর্ধনের রাজ্য সুশাসিত ছিল। কিন্তু তাঁর রাজত্বকালে রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলার কিছুটা অবনতি হয়েছিল। রাজ্যে চোর ডাকাতের উপদ্রব থাকায় তখনকার ফৌজদারি আইন অত্যন্ত কঠোর ছিল। রাজা স্বয়ং মাঝেমাঝে পরিভ্রমণ করে রাজ্যের শাসন-সংক্রান্ত বিষয়ের তত্ত্বাবধান করতেন। হিউয়েন-সাং হর্ষবর্ধনের রাজকর্তব্যবােধের খুবই প্রশংসা করেছেন। নতুন রাজধানী কনৌজ ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধশালী এবং জনবহুল। অন্যান্য নগরের মধ্যে প্রয়াগ, মথুরা, নালন্দা, বারাণসী, তাম্রলিপ্ত ইত্যাদি ছিল উল্লেখযােগ্য। অবশ্য হর্ষবর্ধনের সাম্রাজ্যের বেশিরভাগ অঞ্চলে সামন্ত রাজাদের প্রভাব বৃদ্ধি পাওয়ায় কেন্দ্রীয় সরকারের আধিপত্য কমে যায়। এই প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক রােমিলা থাপারের অভিমত হল, 'হর্ষবর্ধন মৌর্য সম্রাটদের মতাে কোনাে কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা স্থাপন করতে পারেন নি।' এছাড়া হর্ষবর্ধনের আমলে দেশে ব্যাবসাবাণিজ্যেরও বিশেষ প্রসার ঘটে নি। দেশে ভূমিরাজস্ব ও অন্যান্য করের পরিমাণ সামান্যই ছিল।
[৩] সাম্রাজ্যের সংগঠক ও শাসক হিসেবে হর্ষবর্ধনের কৃতিত্ব : হর্ষবর্ধন সুদক্ষ শাসক ছিলেন। শিক্ষা সংস্কৃতির দিক থেকেও হর্ষবর্ধনের রাজত্বকাল প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে এক স্মরণীয় অধ্যায়। হর্ষ নিজেই সুপণ্ডিত ছিলেন এবং শিক্ষা ও সাহিত্যের বিশেষ পৃষ্ঠপােষক ছিলেন। তাঁর রচিত নাগনন্দা, রত্নাবলী ও প্রিয়দর্শিকা বিশেষ খ্যাতি অর্জন করে।বহু খ্যাতনামা পণ্ডিত তার রাজসভা অলংকৃত করেছেন। এদের মধ্যে সর্বাগ্রে উল্লেখযােগ্য হলেন 'হর্ষচরিত’ রচয়িতা বাণভট্ট, কবি ভর্তৃহরি, কবি মৌর্য, জয়সেন, ময়ূর প্রমুখ। হিউয়েন সাঙ-এর বিবরণ থেকে হর্ষবর্ধনের পরধর্মসহিষ্ণুতা ও দানশীলতার পরিচয় পাওয়া যায়।
[৪] হর্ষবর্ধনের শাসনকালের মূল্যায়ন : প্রাচীন ভারতে অশােকের পর হর্ষবর্ধনের মতাে প্রজাহিতৈষী নরপতির দৃষ্টান্ত আর পাওয়া যায় না। তাঁর দীর্ঘ ৪০ বছরব্যাপী শাসনকালে উত্তর ভারতে শান্তির স্বর্গরাজ্য গড়ে ওঠে। অশােকের মতাে তিনি প্রজাদের সুবিধার জন্য চিকিৎসালয় ও বিশ্রামাগার নির্মাণ করেছিলেন। প্রসঙ্গত রাধাকুমুদ মুখােপাধ্যায় বলেছেন যে, 'হর্ষবর্ধনের চরিত্রে সমুদ্রগুপ্তের সমরকুশলতা ও অশােকের প্রজাহিতৈষণার অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছিল।' এই বক্তব্যকে সমর্থন জানিয়ে ঐতিহাসিক বােলিনসন যথার্থই বলেছেন যে, অশােক ও আকবরকে বাদ দিলে হর্ষবর্ধন ছিলেন ভারতের শ্রেষ্ঠ নরপতি।'
[৪] বাংলার পাল বংশ
শশাঙ্কের মৃত্যুর পর বাংলা অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ক্ষেত্রে সংকটজনক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। বাংলার রাজনৈতিক ঐক্য ব্যাহত হয় এবং খণ্ড খণ্ড রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এইভাবে যে অরাজকতাপূর্ণ পরিস্থিতির উদ্ভব হয় তা মাৎস্যন্যায় নামে পরিচিত। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাংলার স্থানীয় নেতারা গােপাল নামে এক জনপ্রিয় সামন্তকে বাংলার রাজপদে নির্বাচিত করেন। গােপালের এই নির্বাচনকে ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার 'রক্তপাতহীন বিপ্লব' এর সাথে তুলনা করেছেন। এইভাবে বাংলায় পাল বংশের প্রতিষ্ঠা হয়।
[১] ধর্মপাল (৭৭০-৮১০ খ্রিস্টাব্দ): গােপালের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র ধর্মপাল রাজা হন। তাঁর রাজত্বকালে বাংলার ছােট্ট পালরাজ্য সর্বভারতীয় সাম্রাজ্যের মর্যাদায় উন্নীত হয়। সে-সময়ে উত্তর-ভারতের প্রভুত্বের প্রশ্নে রাষ্ট্রকূট ও প্রতিহারদের মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছিল। ধর্মপাল এই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যােগ দেন। সাম্রাজ্য বিস্তারের উদ্দেশ্যে ধর্মপাল পশ্চিম দিকে অগ্রসর হলে প্রতিহার-রাজ বৎসরাজ-এর কাছে পরাস্ত হন। রাষ্ট্রকূট রাজ ধ্রুব বৎসরাজকে পরাস্ত করে ধর্মপালের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। এর মধ্যেই ধর্মপাল মগধ, বারাণসী ও প্রয়াগ জয় করেন। কিন্তু ধ্রুবের কাছে তিনি পরাস্ত হন। ধ্রুব দাক্ষিণাত্যে ফিরে গেলে ধর্মপাল কনৌজ আক্রমণ করে তা দখল করেন এবং সিন্ধুনদ ও পাঞ্জাব পর্যন্ত অগ্রসর হন। মৃত্যুকাল পর্যন্ত তিনি উত্তর-ভারতে পালবংশের আধিপত্য বজায় রাখতে পেরেছিলেন।
[২] দেবপাল (৮১০-৮৫০ খ্রিস্টাব্দ): ধর্মপালের মৃত্যুর পর তার সুযােগ্য পুত্র দেবপাল-সিংহাসনে বসেন। দেবপাল ছিলেন পালবংশের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজা। পিতার মতাে তিনিও ছিলেন সাম্রাজ্যবাদী। দক্ষিণে বিন্ধ্য পর্বত ও পশ্চিমে কাশ্মীরের সীমান্ত পর্যন্ত তার প্রভুত্ব বিস্তৃত ছিল। দেবপাল উড়িষ্যা ও কামরূপের দিকে অগ্রসর হয়ে বাংলার এই দুই সীমান্ত রাজ্য জয় করেন। প্রকৃতপক্ষে প্রায় সমগ্র উওর-ভারতে তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। দেবপালের আমলে পাল সাম্রাজ্য গৌরবের চরম শিখরে উঠেছিল।
[৩] প্রথম মহীপাল (৯৮৮-১০৩৮ খ্রিস্টাব্দ):
দেবপালের মৃত্যুর পর পাল সাম্রাজ্য সাময়িকভাবে দুর্বল
হয়ে পড়ে। পাল সাম্রাজ্যের এই ঘাের দুর্দিনে প্রথম মহীপাল বাংলার সিংহাসনে বসেন। অল্প সময়ের মধ্যে তিনি উত্তর ও পূর্ববঙ্গ পুনরুদ্ধার করেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে প্রথম মহীপালকে দাক্ষিণাত্যের পরাক্রান্ত চোলরাজ রাজেন্দ্র চোলের আক্রমণের সম্মুখীন হতে হয়। যাই হােক, চোলরা ফিরে গেলে প্রথম মহীপাল একাধিক যুদ্ধে জয়লাভ করে মিথিলা (উত্তর-বিহার) ও বারাণসী আবার দখল করে নেন। মহীপাল যে শুধু সুদক্ষ যােদ্ধাই ছিলেন তা নয়, তিনি শিক্ষা ও সংস্কৃতিরও পৃষ্ঠপােষক ছিলেন।
[4] রামপাল (১০৭৭-১১৩০ খ্রিস্টাব্দ) ও পাল সাম্রাজ্যের বিলুপ্তি :
পালবংশের শেষ শক্তিশালী রাজা ছিলেন রামপাল। সিংহাসনে বসেই রামপাল বরেন্দ্রভূমি পুনরুদ্ধার করেন। এছাড়া কামরূপ ও উৎকল বিজয় এবং চালুক্যও গাহড়বালদের আক্রমণ প্রতিরােধ হল রামপালের অন্যতম কৃতিত্ব। তার মৃত্যুর পর উল্লেখযােগ্য রাজার অভাবে পাল সাম্রাজ্যের বিলুপ্তি ঘটে।
[৫] বাংলার সেন বংশ
পালযুগে বাংলা একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন রাজ্যের মর্যাদা লাভ করে। কিন্তু তাদের পতনের পর বাংলায় যে রাজনৈতিক, অনৈক্য ও অনিশ্চয়তা দেখা দেয় তা দূর করে সামন্ত সেনের পৌত্র বিজয় সেন বাংলায় একটি অখণ্ড শক্তিশালী রাজ্য স্থাপন করেছিলেন।
[১] বল্লাল সেন (১১৫৮-৭৯ খ্রিস্টাব্দ): বিজয় সেনের পর তার পুত্র বল্লাল সেন সিংহাসনে বসেন। পিতার মতাে বল্লাল সেনও রাজ্যবিস্তারে প্রবৃত্ত হন। বল্লাল-চরিত গ্রন্থে বল্লাল সেনের মগধ ও মিথিলা জয়ের কথা জানা যায়। বল্লালসেনের রাজ্য পশ্চিমে মগধ ও মিথিলা থেকে পূর্ববঙ্গ পর্যন্ত এবং উত্তরে দিনাজপুর ও বগুড়া থেকে দক্ষিণে সমুদ্র উপকুল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এই সুবিস্তৃত রাজ্যের অনেক জায়গায় বল্লালের কীর্তি আজও বিদ্যমান। সামরিক খ্যাতি ছাড়াও বল্লাল সেনের সমাজ সংস্কারক হিসাবেও খ্যাতি ছিল। দানসাগর ও অদ্ভুতসাগর নামে দুটি গ্রন্থ রচনা করে তিনি সমকালীন পণ্ডিতসমাজে খ্যাতি লাভ করেছিলেন। অনেকে মনে করেন যে, বল্লাল সেন বাংলায় কৌলিন্য প্রথা প্রবর্তন করেন। কিন্তু এই অনুমান বর্তমান ইতিহাসবিদরা সত্যি বলে মনে করেন না।
[২] লক্ষ্মণ সেন (১১৭৯-১২০৬ খ্রিস্টাব্দ):
বল্লাল সেনের পুত্র লক্ষ্মণ সেনকে বাংলার শেষ স্বাধীন হিন্দু নরপতি বলা যায়। গৌড়, কামরূপ, কলিঙ্গ ও কাশীর রাজারা তার প্রভুত্ব স্বীকার করেছিলেন। এলাহাবাদ ও বারাণসী পর্যন্ত তিনি সমর অভিযান চালান। কিন্তু রাজত্বের শেষ ভাগে তার সামরিক শক্তি হীনবল হয়ে পড়ে। দ্বাদশ শতকের শেষভাগে ১১৯৭ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবকের সেনাপতি ইখতিয়ারউদ্দিন বখতিয়ার খলজী অতর্কিতে লক্ষ্মণ সেনের রাজধানী নদীয়া আক্রমণ করেন। কিন্তু এই আক্রমণের বিরুদ্ধে কোনাে প্রতিরােধ গড়ে না তুলে বিনা প্রতিরােধে লক্ষ্মণ সেন পূর্ববঙ্গে পালিয়ে যান। সেখানেই ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে তার মৃত্যু ঘটে।
[৩] সেন বংশের পতন : লক্ষ্মণ সেনের পর সেন বংশ পূর্ব ও দক্ষিণবঙ্গে আরও পঞ্চাশ বছর ক্ষমতাসীন ছিল। তবে তাঁর দুর্বল বংশধরেরা আত্মকলহে সংশ্লিষ্ট হওয়ায় সেন রাজ্য ভাঙনের সম্মুখীন হয় এবং বিভিন্ন এলাকায় একাধিক স্বাধীন রাজ্য গড়ে উঠে। ত্রয়ােদশ শতকে সমগ্র বাংলায় মুসলমান আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
- [খ] দাক্ষিণাত্য
[১] বাতাপির চালুক্য বংশ
গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর উত্তর ভারতের মতাে দাক্ষিণাত্যেও তিনটি শক্তিশালী রাজবংশের উদ্ভব ঘটে, এরা ছিল : (১) চালুক্য বংশ, (২) পল্লব বংশ এবং (৩) চোল বংশ।
এই বংশগুলিকে কেন্দ্র করে বেশ কয়েকটি স্বাধীন রাজ্যের উত্থান ঘটে। এই রাজ্যগুলির মধ্যে চালুক্য রাজবংশ ছিল বিশেষ উল্লেখযােগ্য। চালুক্যরা প্রথমে উত্তর কর্ণাটকের বাতাপি ও তার সংলগ্ন অঞলে রাজ্য গড়ে তােলে। তারপর তারা বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে। ইতিহাসে চালুক্যদের চারটি শাখার উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন : (১) বাতাপির চালুক্য বা পশ্চিমী চালুক্য বংশ; (২) বেঙ্গীর চালুক্য বংশ; (৩) কল্যাণের চালুক্য বংশ এবং (৪) গুজরাটের চালুক্য বংশ। বাতাপি বা বাদামিকে কেন্দ্র করে এই বংশের উত্থান ঘটে বলে এদের বাতাপির চালুক্য বলা হয়।
[১] চালুক্য রাজ দ্বিতীয় পুলকেশী (৬১০-৪২ খ্রিস্টাব্দ) : খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকে দাক্ষিণাত্যের বাতাপিকে কেন্দ্র করে চালুক্য বংশের উত্থান একটি উল্লেখযােগ্য ঘটনা ছিল। প্রথম পুলকেশী এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা হলেও তার পুত্র দ্বিতীয় পুলকেশী ছিলেন চালুক্য বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্রাট। রবিকীর্তির রচিত আইহােল শিলালিপি থেকে তার কৃতিত্বের কথা জানা যায়। ব্যক্তিগত জীবনে দ্বিতীয় পুলকেশী ছিলেন ঘাের সাম্রাজ্যবাদী। তিনি মহীশূরের গঙ্গরাজ্য, মালাবারের অনুপ অঞ্চল, কোঙ্কনের মৌর্য রাজ্য ও গুজরাট জয় করেন। তার সামরিক অভিযানের অন্যতম পদক্ষেপ হল উত্তর ভারতের শ্রেষ্ঠ নরপতি হর্ষবর্ধন-এর বিরুদ্ধে সাফল্য। পরবর্তী সময়ে দক্ষিণ ভারতে পল্লব রাজ প্রথম মহেন্দ্রবর্মন তাঁর কাছে পরাজিত হন এবং পল্লবদের রাজধানী কাঞ্জী পর্যন্ত অঞ্চল তার অধিকারে আসে। এরপর তিনি দাক্ষিণাত্যের গােদাবরী থেকে কৃষ্ণা নদী পর্যন্ত জয় করতে সক্ষম হন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে মহেন্দ্রবর্মনের পুত্র নরসিংহ বর্মন পিতার পরাজয়ের প্রতিশােধ নেবার জন্য বাতাপি আক্রমণ করলে সেই যুদ্ধে দ্বিতীয় পুলকেশী পরাজিত ও নিহত হন। দ্বিতীয় পুলকেশী ছিলেন একজন পরধর্মসহিষ্ণু শাসক। ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রতি অনুরক্ত থাকলেও তিনি অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতিও সহানুভূতিসম্পন্ন ছিলেন। তিনি পারস্য সম্রাট দ্বিতীয় মসরুর রাজসভায় দূত পাঠান। চিনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ দ্বিতীয় পুলকেশীর শাসন-দক্ষতা ও জনহিতকর কাজের প্রশংসা করে তাকে 'দক্ষিণ ভারতের শ্রেষ্ঠ রাজা' বলে অভিহিত করেছেন।
[৩] পরবর্তী চালুক্যরাজগণ ও চালুক্য শক্তির পতন : দ্বিতীয় পুলকেশীর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র প্রথম বিক্রমাদিত্য বাতাপির সিংহাসনে বসেন। তিনি পল্লবদের আধিপত্য বিনষ্ট করে চালুক্য শক্তির আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন। তাঁর পুত্র দ্বিতীয় বিক্রমাদিত্য আরব শক্তির বিরুদ্ধে আক্রমণ চালিয়ে সাফল্য অর্জন করেন। পরবর্তী চালুক্যরাজ দ্বিতীয় কীর্তিবর্মন রাষ্ট্রকুটরাজ দস্তিদুর্গের কাছে পরাস্ত হওয়ায় চালুক্য শক্তির পতন ঘটে।
[২] রাষ্ট্রকূট বংশ
অষ্টম শতকের মধ্যভাগে চালুক্য বংশের উচ্ছেদ করে রাষ্ট্রকূটরা দক্ষিণ-ভারতে প্রাধান্য স্থাপন করে। সম্ভবত, রাষ্ট্রকূটরা প্রথমে চালুক্য রাজবংশের অধীনে সামন্ত ছিল এবং তাদের ভাষা ছিল কানাড়ী। রাষ্ট্রকুট বংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন দন্তিদুর্গ। তিনি মহারাষ্ট্র, কাশী, কলিঙ্গ,
মালব, গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ ও বেরাবে নিজের প্রভুত্ব স্থাপন করেছিলেন। তার শক্তিবৃদ্ধিতে ভীত হয়ে চালুক্যরাজ দ্বিতীয় কীর্তিবর্মন দন্তিদুর্গের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। কিন্তু এই যুদ্ধে চালুক্যরাজ পরাস্ত হলে (৭৫৩ খ্রিঃ) দস্তিদুর্গ মহারাজাধিরাজ উপাধি ধারণ করেন।
[১] প্রথম কৃষ্ণ : দস্তিদুর্গের পর তাঁর পুত্র প্রথম কৃষ্ণ সিংহাসনে বসেন (৭৫৮-৭৩ খ্রিঃ)। প্রথম কৃষ্ণ চালুক্যরাজ দ্বিতীয় কীর্তিবর্মণকে পরাস্ত করলে বাতাপির চালুক্য সাম্রাজ্যের বিলুপ্তি ঘটে। প্রথম কৃষ্ণের আমলে ইলােরার কৈলাসনাথের মন্দিরটি তৈরি হয়।
[২] দ্বিতীয় গােবিন্দ এবং ধ্রুব : প্রথম কৃষ্ণের পর তার পুত্র দ্বিতীয় গােবিন্দ সিংহাসনে বসেন (৭৭৩-৮০ খ্রিঃ)। কিন্তু তার অযােগ্যতার সুযােগে কনিষ্ঠ ভ্রাতা ধ্রুব সিংহাসন দখল করেন। সিংহাসনে বসেই ধ্রুব রাজ্যবিস্তারে বেরিয়ে পড়েন। মহীশূরের গঙ্গা-বংশীয় রাজা, বেঙ্গীর চালুক্যরাজ ও পল্লব রাজাকে পরাস্ত করে তিনি সমগ্র দাক্ষিণাত্যে রাষ্ট্রকুট সাম্রাজ্যের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। প্রকৃতপক্ষে ধ্রুবের রাজত্বকালেই রাষ্ট্রকূট শক্তি প্রবল হয়ে ওঠে।
[৩] তৃতীয় গােবিন্দ (৭৯৩-৮১৪ খ্রিস্টব্দ):
ধ্রুবর পর তৃতীয় গােবিন্দ সিংহাসনে বসেন। রাজত্বের প্রথম দিকে তাকে অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমনে ব্যস্ত থাকতে হয়। অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমন করার পর তৃতীয় গােবিন্দ রাজ্যজয়ে উদ্যোগী হন। পল্লব রাজ দন্তিবর্মন এবং বেঙ্গী-রাজ চতুর্থ বিষ্ণুবর্মন একরকম বিনা যুদ্ধেই তৃতীয় গােবিন্দের বশ্যতা স্বীকার করে নেন। এরপর তিনি উত্তরভারতে প্রভুত্ব বিস্তারে ব্রতী হয়ে মালব, কোশল, কলিঙ্গ, বেঙ্গী প্রভৃতি রাজ্যগুলি রাষ্ট্রকুট সাম্রাজ্যের অধিকারে আনেন।
[৪] তৃতীয় কৃষ্ণ(৯১৪-২২ খ্রিস্টব্দ): রাষ্ট্রকূট বংশের শেষ উল্লেখযােগ্য রাজা ছিলেন তৃতীয় কৃষ্ণ। উত্তর-ভারতে তিনি বুন্দেলখন্ড, মালব ও উজ্জয়িনী জয় করেন। দক্ষিণ-ভারতে তিনি চোল, পাণ্ড্য, কেরল প্রভৃতি রাজ্যের রাজাদের পরাস্ত করে রামেশ্বর সেতুবন্ধে তার বিজয়স্তম্ভ বসান। রাষ্ট্রকুট রাজ তৃতীয় কৃষ্ণকে প্রকৃতপক্ষে সমগ্র দাক্ষিণাত্যের সর্বাধিনায়ক বলা যায়। এমনকি সিংহলের রাজাও তৃতীয় কৃষ্মের বশ্যতা স্বীকার করে উপঢৌকন পাঠিয়েছিলেন।
তৃতীয় কৃষ্ণের পর রাষ্ট্রকূট বংশের গৌরব অস্তমিত হতে থাকে এবং একে একে প্রদেশগুলি স্বাধীন হয়ে যায়। অবশেষে ৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে কল্যাণের চালুক্য রাজার কাছে এই বংশের শেষ রাজা চতুর্থ অমােঘবর্ষ পরাস্ত হলে রাষ্ট্রকূট বংশের অবসান ঘটে।
[৩] কল্যাণের চালুক্যবংশ
বাতাপির চালুক্যদের অন্য-এক শাখা ছিল কল্যাণের চালুক্যরা। ৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে তৈলপ নামে এক চালুক্য সামন্ত রাষ্ট্রকুট বংশের শেষ রাজা চতুর্থ অমোঘবর্ষকে পরাস্ত করে চালুক্যবংশের পুন:প্রতিষ্ঠা করেন। তার মৃত্যুর পর সত্যাশ্রয়, দ্বিতীয় জয়সিংহ, প্রথম সােমেশ্বর ও দ্বিতীয় সােমেশ্বর যথাক্রমে ১০৭৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন।
ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্য : দ্বিতীয় সােমেশ্বরের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্য সিংহাসনে বসেন। ১০৭৬ থেকে ১১২৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। যষ্ঠ বিক্রমাদিত্য ছিলেন কল্যাণের চালুক্যবংশের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজা। তার সভাকবি বিলহন রচিত 'বিক্রমাঙ্কদেব চরিত' নামে গ্রন্থে তার সামরিক প্রতিভা ও রাজ্যজয়ের বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায়। তিনি চোল-রাজ কুলোতুঙ্গকে পরাস্ত করে চোল রাজধানী দখল করেন।
ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্য শুধু সামরিক প্রতিভারই অধিকারী ছিলেন না; তিনি ছিলেন বিদ্যোৎসাহী ও সাহিত্যনুরাগী। “বিক্রমাঙ্কদেব চরিত’ প্রণেতা বিলহন ছাড়াও 'মিতাক্ষরা' শাস্ত্রের রচয়িতা বিজ্ঞানেশ্বর তাঁর সভা অলংকৃত করেছিলেন। যষ্ঠ বিক্রমাদিত্যের পর থেকে কল্যাণের চালুক্য বংশের পতন শুরু হয় এবং শেষ পর্যন্ত হােয়সল ও যাদবরা চালুক্য রাজ্য দখল করে নেয়।
[গ] দক্ষিণ-ভারত :
[১] কাঞ্চির পল্লব বংশ
গুপ্তসাম্রাজ্যের পতনের পর ষষ্ঠ শতকের মধ্যভাগ থেকে নবম শতক পর্যন্ত পল্লব বংশ দক্ষিণ ভারতের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। কৃষ্ণা নদীর দক্ষিণে কাঞ্চি নগরকে কেন্দ্র করে এই রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয় (আনুমানিক ৩৫০ খ্রিস্টাব্দ)।
[১] পল্লব বংশের প্রথমদিকের নৃপতিগণ :
পল্লব বংশের প্রথম স্বাধীন রাজা ছিলেন শিবস্কন্দবর্মন।।
পল্লবদের পরবর্তী উল্লেখযােগ্য রাজা সিংহবিষ্ণু ৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে কাঞ্চির সিংহাসনে বসেন। এই সময় থেকে পল্লব বংশের রাজনৈতিক প্রতিপত্তি ও গৌরবময় যুগের সূচনা হয়। তিনি কাবেরী নদী পর্যন্ত পল্লবরাজ্য বিস্তার করেন। তিনি চোল, চের, পাণ্ড্য ও সিংহলের রাজাদের পরাস্ত করেন। 'কিরাতার্জুনিও’ গ্রন্থের রচয়িতা ভারবী সিংহবিষ্ণুর সভাকবি ছিলেন।
[২] প্রথম মহেন্দ্রবর্মন (৬০০-৬৩০ খ্রিস্টাব্দ): সিংহবিষ্ণুর পর তাঁর পুত্র প্রথম মহেন্দ্রবর্মন সিংহাসনে বসেন কিন্তু তিনি চালুক্যরাজ দ্বিতীয় পুলকেশীর কাছে পরাস্ত হয়ে বেঙ্গী প্রদেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হন। তাঁর সময় থেকে দক্ষিণ ভারতের প্রভুত্বের প্রশ্নে চালুক্য ও পল্লবদের মধ্যে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও সংঘর্ষের সূচনা হয়। তিনি শিল্প ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপােষক ছিলেন।
[৩] প্রথম নরসিংহবর্মন (৬৩০-৬৬৮ খ্রিস্টাব্দ) : মহেন্দ্রবর্মনের পুত্র প্রথম নরসিংহবর্মন ছিলেন পল্লব বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ ও পরাক্রমশালী রাজা।তিনি চালুক্যরাজ দ্বিতীয় পুলকেশীকে পরাজিত ও নিহত করে 'মহামল্ল’ অভিধা ধারণ করেন। তিনি সিংহলে দুটি নৌ-অভিযান পাঠিয়ে নিজের বন্ধু মনিবর্মাকে সিংহলের সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত করেন।
প্ৰথম নরসিংহবর্মনের রাজত্বকালে হিউয়েন সাঙ পল্লব রাজ্য পরিভ্রমণে আসেন। তার ভ্রমণ বৃত্তান্ত থেকে পল্লব রাজ্যের ঐশ্বর্য ও সমৃদ্ধির কথা জানা যায়। নরসিংহবর্মন শিল্প ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপােষক ছিলেন। তাঁর আমলে 'মহাবলীপুরম' -এর বিখ্যাত রথমন্দির তৈরি করা হয়।
[৫] দ্বিতীয় নন্দীবর্মন (৭৩০-৭৯৬ খ্রিষ্টাব্দ) : পল্লব বংশের পরবর্তী উল্লেখযোগ্য রাজা ছিলেন দ্বিতীয় নন্দীবর্মন। তিনি ৭৩০ থেকে ৭৯৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। চালুক্য- রাজ দ্বিতীয় বিক্রমাদিত্য দুবার কাঞ্চি দখল করেন ও প্রচুর ধনসম্পদ লুঠ করে ফিরে যান। ৭৫০ খ্রিস্টাব্দে রাষ্ট্রকূটদের সঙ্গে পল্লবদের সংঘর্ষ বাধলে রাষ্ট্রকূট রাজ দন্তীদুর্গ কাঞ্চি দখল করে নেন।এইসব বিপর্যয় সত্ত্বেও দ্বিতীয় নন্দীবর্মন নিজের রাজ্য অক্ষুন্ন রাখতে সমর্থ হন। দ্বিতীয় নন্দীবর্মনের মৃত্যুর পর পল্লবরাজ্যের ক্রমেই পতন শুরু হয়। কিন্তু পল্লববংশের পরবর্তী রাজা তৃতীয় নন্দীবর্মন পাণ্ড্যগণকে পরাস্ত করে রাজ্যের হৃত অঞ্চলগুলি পুনরুদ্ধার করেন। পল্লব বংশের শেষ রাজা ছিলেন অপরাজিত। ৮৯১ খ্রিস্টাব্দে চোল রাজ আদিত্য অপরাজিতকে পরাজিত করেন। সেই সঙ্গে এই বংশের অবসান ঘটে এবং দক্ষিণ-ভারতে চোলদের প্রতিপত্তি স্থাপিত হয়।
[২] চোল বংশ
চোলরা ছিল দক্ষিণ-ভারতের এক অতি প্রাচীন জাতি। বর্তমানের তাঞ্জোর, ত্রিচিনাপল্লী প্রভৃতি অঞ্চল নিয়ে প্রাচীন চোল রাজ্যটি গঠিত ছিল। মহাভারত এবং মেগাস্থিনিসের বিবরণী ও অশােকের শিলালিপিতে স্বাধীন চোলরাজ্যের উল্লেখ আছে। চোল রাজ্যের প্রথম ঐতিহাসিক রাজা ছিলেন কারিকল।
নবম শতকে পল্লব বংশের পতন শুরু হলে পল্লবদের এক সামন্তরাজা বিজয়ালয়ের নেতৃত্বে চোলশক্তির পুনরুত্থান ঘটে। তিনি পাণ্ড্যদের কাছ থেকে তাঞ্জোর দখল করে নেন। সেই সময় থেকে তাঞ্জোর চোল রাজ্যের রাজধানী হয়। বিজয়ালয়ের পর তার পুত্র প্রথম আদিত্য (৮৮০-৯০৭ খ্রিস্টাব্দ) চোলবংশের প্রতিপত্তি ও মর্যাদা বৃদ্ধি করেন।
[১] চোল রাজ প্রথম পরান্তক (৯০৭-৯৪৬ খ্রিস্টাব্দ):
চোল রাজ আদিত্যের পুত্র প্রথম পরান্তক ছিলেন দক্ষিণ ভারতে চোলশক্তির যথার্থ প্রতিষ্ঠাতা। তিনি উত্তরে নেলাের পর্যন্ত চোলরাজ্য বিস্তার করেন এবং পান্ড্যরাজ জয়সিংহকে যষ্ঠ বিক্রমাদিত্যের সিংহলে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেন। চোলশক্তির ক্রমবিস্তারে আতঙ্কিত হয়ে রাষ্ট্রকূট রাজ তৃতীয় কৃষ্ণ মহীশূরের গঙ্গ রাজার সাহায্যে পরান্তককে পরাস্ত করেন। এর ফলে কিছুদিনের জন্য চোলশক্তি হীনবল হয়ে পড়ে। পরান্তক শিক্ষা ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপােষক ছিলেন।
[2] প্রথম রাজরাজ (৯৮৫-১০১৪ খ্রিস্টাব্দ) : প্রথম রাজ-রাজ (মহান) ছিলেন চোলরাজ্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠরাজা। রাজরাজের ‘তাঞ্জোর-লিপি' তে তার সামরিক কৃতিত্বের উল্লেখ আছে। তার অন্যতম কৃতিত্ব হল চোল নৌ-শক্তির প্রতিষ্ঠা, যা ছিল চোলদের সামরিক শক্তির প্রধান অঙ্গ। চোল নৌ-বাহিনীর প্রথম সাফল্য হল চের নৌবাহিনীর ধ্বংসসাধন। রাজত্বের প্রথমদিকে তিনি ত্রিবান্দ্রমের কাছে চেরদের পরাস্ত করেন। এরপর তিনি পাণ্ড্যরাজকে পরাস্ত করে মাদুরা দখল করেন। এক বিরাট নৌ-অভিযান চালিয়ে প্রথম রাজ-রাজ সিংহলের উত্তরাঞ্চল দখল করেন এবং অনুরাধাপুরে চোল অধিকৃত সিংহলের রাজধানী স্থাপন করেন। পশ্চিম সাগরে অবস্থিত লাক্ষাদ্বীপ ও মালদ্বীপের ওপরে প্রভুত্ব স্থাপনের পর মাদ্রাজ, মহীশুরের কিছু অংশ ও কুর্গ তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। সুমাত্রার রাজা শ্রীবিজয়ের সঙ্গে প্রথম রাজ-রাজের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। রাজ-রাজ ছিলেন সাহিত্যের ও সংস্কৃতির পরম পৃষ্ঠপােষক। তাঞ্জোরের বিখ্যাত রাজ-রাজের মন্দির তার উল্লেখযােগ্য কীর্তি। প্রথম রাজ-রাজ যে শুধু মহান বিজেতাই ছিলেন তা নয়, তাঁর শাসনদক্ষতাও ছিল প্রশংসনীয়। তিনি ৯৮৫ থেকে ১০১৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন।
[৩] প্রথম রাজেন্দ্ৰ চোল (১০১৪-১০৪৪ খ্রিঃ) : প্রথম রাজ-রাজের পুত্র রাজেন্দ্র চোল ছিলেন চোলবংশের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজা। তিনি ‘গঙ্গাইকোন্ড চোল’ ও ‘উত্তমচোল' নামেও পরিচিত ছিলেন। তাঁর আমলে চোল শক্তি উন্নতির চরম শিখরে ওঠে।সিংহাসনে আরােহণ করেই তিনি এক বিরাট নৌবাহিনী নিয়ে সিংহল আক্রমণ করেন। যুদ্ধে জয়ী হয়ে তিনি সিংহল চোল সাম্রাজ্যের অঙ্গীভূত করেন। ১০১৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি চের (কেরল) ও পাণ্ড্যদের উপর আধিপত্য স্থাপন করেন এবং নিজের পুত্রকে এই রাজ্যগুলির শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। রাজেন্দ্র চোলের রাজ্যবিস্তার শুধু দক্ষিণ-ভারতেই সীমাবদ্ধ হয়ে ছিল না। তিনি পূর্ববঙ্গের গােবিন্দচন্দ্র, পশ্চিমবঙ্গের মহীপাল ও দক্ষিণবঙ্গের রণসূরকে পরাস্ত করেন। শক্তিশালী নৌবহরের সাহায্যে রাজেন্দ্ৰ চোল বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত আন্দামান ও নিকোবরদ্বীপপুঞ্জ এবং অন্যদিকে মালব জয় করে অবিস্মরণীয় কীর্তি স্থাপন করেন। প্রথম রাজেন্দ্র চোলের সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য কৃতিত্ব হল সুমাত্রার শৈলেন্দ্রবংশের বিরুদ্ধে নৌ-অভিযান। ১০২৫ খ্রিস্টাব্দে শৈলেন্দ্র সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী নৌবহর পাঠান হলে শৈলেন্দ্র রাজ বিজয়ােতুঙ্গবৰ্মন পরাস্ত হয়ে বন্দি হন এবং এর ফলে শৈলেন্দ্র সাম্রাজ্যের কিছু অঞ্চল চোলদের দখলে আসে। প্রসঙ্গত ঐতিহাসিক রােমিলা থাপার বলেছেন যে, ভারতের কোনাে রাজা এর আগে ভারতের বাইরে এই ধরনের সামরিক সাফল্য অর্জন করতে পারেননি।
[৪] রাজাধিরাজ বীর রাজেন্দ্র (১০৪৪-৫২ খ্রিস্টব্দ) : প্রথম রাজেন্দ্র চোলের পর তার পুত্র রাজাধিরাজ সিংহাসনে বসেন। তিনি পান্ড্য ও চের রাজাদের আবার দমন করেন। চোলদের পরবর্তী উল্লেখযােগ্য রাজা ছিলেন বীর রাজেন্দ্র (১০৬৪-৭০ খ্রিঃ)। তিনি দু'বার পশ্চিমী চালুক্যদের আক্রমণ প্রতিহত করে চোল সাম্রাজ্যের অখন্ডতা রক্ষা করেন।
চোলরাজ কুলােতুঙ্গের (১০৭০-১১২০ খ্রিঃ) মৃত্যুর পর অভ্যন্তরীণ গােলযােগ এবং পান্ড, কাকতীয় ও হােয়সলদের ক্রমাগত আক্রমণে ফলে চোল-রাজ্যের বিলুপ্তি ঘটে।
চোলদের সামুদ্রিক কার্যকলাপ : রাজনৈতিক দিক থেকে চোলদের অভ্যুত্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রশাসনের ক্ষেত্রে চোল রাজারা অসাধ্য কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন। চোলদের নৌশক্তির প্রাধান্যের ফলে কিছুদিন অন্তত বঙ্গোপসাগর চোলহ্রদে পরিণত হয়েছিল এবং বৃহত্তর ভারতীয় দেশগুলিতে ভারতীয় সামুদ্রিক ব্যাবসাবাণিজ্য নিরাপদ হয়।
সে-যুগে নৌ-শক্তিতে চোলরা ছিল অপ্রতিদ্বন্দ্বী।চোলরাজাদের সামুদ্রিক তৎপরতার ফলশ্রুতি হল, নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে নৌ-ঘাঁটির প্রতিষ্ঠা ও মালয়ের উপকূল অঞ্চলে আধিপত্যের প্রতিষ্ঠা। চিন দেশের সঙ্গেও চোলদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল।
[৩] রাজনৈতিক আধিপত্য লাভের প্রতিদ্বন্দ্বিতা : (ত্রিশক্তি সংগ্রাম)
হর্ষবর্ধনের পরবর্তী যুগে আর্যাবর্তের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কনৌজ ছিল কেন্দ্রবিন্দু। কনৌজে প্রাধান্য স্থাপনকে কেন্দ্র করে এই যুগে মালবের গুর্জর-প্রতিহার, দক্ষিণ ভারতের রাষ্ট্রকুট ও বাংলার পালবংশের মধ্যে এক প্রবল ‘ত্রি-শক্তি সংগ্রামের উদ্ভব হয়। ত্রিশক্তি সংগ্রাম ছিল হর্ষবর্ধনের পরবর্তী যুগে ভারতের ইতিহাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
[১] ত্রিশক্তি সংগ্রামের প্রথম পর্ব : প্রতিহার বংশের রাজা বৎসরাজ ৭৮৩ খ্রিস্টাব্দে উত্তর প্রদেশের কনৌজ নগরটি দখল করেন। প্রতিহাররা কনৌজ দখল করলে তাদের সঙ্গে দক্ষিণ ভারতের রাষ্ট্রকূট এবং বাংলার পাল রাজাদের সংঘর্ষ বাধে। প্রতিহার-বৎসরাজ বাংলার পালবংশীয় রাজা ধর্মপালকে পরাস্ত করেন ও গঙ্গা-যমুনা উপত্যকায় উত্তর-ভারতের এক বিশাল অঞ্চল দখল করেন। কিন্তু ইতিমধ্যে রাষ্ট্রকুট বংশীয় রাজা ধ্রুব বৎসরাজকে পরাস্ত করলে বৎসরাজ কনৌজ ছেড়ে চলে যান। ধ্রুব ধর্মপালের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন এবং তাঁকে পরাজিত করেন। কিন্তু ধ্রুব বাংলার দিকে অগ্রসর না হয়ে দাক্ষিণাত্যে ফিরে যাওয়ায় ধর্মপাল কনৌজসহ উত্তর ভারতের বিরাট অংশে আধিপত্য বিস্তার করেন। ফলস্বরূপ ত্রি-শক্তি সংগ্রামের প্রথম পর্বের যুদ্ধে বাংলার পাল রাজারাই লাভবান হন।
[২] ত্রিশক্তি সংগ্রামের দ্বিতীয় পর্ব : ধর্মপালের এই আধিপত্য দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। নবম শতকের প্রথম দিকে প্রতিহার রাজ দ্বিতীয় নাগভট্ট কনৌজ আক্রমণ করে তা দখল করে নেন। এরপর তিনি বাংলার দিকে অগ্রসর হয়ে মুঙ্গেরের কাছে ধর্মপালকে পরাজিত করেন। ঠিক এই সময়ে রাষ্ট্রকূট রাজা তৃতীয় গােবিন্দ নাগভট্টকে প্রতিরােধ করে পরাজিত করতে সমর্থ হন। কিন্তু তৃতীয় গােবিন্দ দাক্ষিণাত্যে ফিরে গেলে ধর্মপাল আবার হৃতরাজ্য উদ্ধার করেন। সেই অর্থে ত্রিশক্তিসংগ্রামের দ্বিতীয় পর্বের যুদ্ধেও ধর্মপাল লাভবান হন।
[৩] ত্রিশক্তি সংগ্রামের তৃতীয় পর্ব : ধর্মপালের পুত্র দেবপাল প্রতিহার রাজ প্রথম ভােজ বা মিহির ভােজ রাষ্ট্রকূটদের পরাজিত করে দক্ষিণ ভারতে আধিপত্য বিস্তার করেন। এই ভাবে তৃতীয় পর্বের যুদ্ধেও পাল রাজারা তাদের বিজয় গৌরব বজায় রাখতে সমর্থ হন।
[৪] ত্রিশক্তি সংগ্রামের চতুর্থ পর্ব : দেবপালের মৃত্যুর পর পালবংশের দুর্বলতা এবং বহিরাক্রমণের ফলে রাষ্ট্রকুটরাজ্যের বিশৃঙ্খলার সুযােগ নিয়ে প্রতিহাররাজ প্রথম ভােজ বুন্দেলখন্ড জয় করেন। এরপর তিনি মগধের সীমান্ত পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে পালবংশীয় রাজাকে পরাস্ত করেন ও বাংলার কিছু অংশ দখল করে নেন। রাষ্ট্রকূট রাজ দ্বিতীয় কৃষ্ণকে পরাস্ত করে প্রতিহার রাজ প্রথম ভোজ মালব ও গুজরাট দখল করেন। পরবর্তী প্রতিহার-রাজ প্রথম মহেন্দ্রপাল (৮৮৫-৯১০ খ্রিঃ) পালরাজা নারায়ণপালকে পরাস্ত করে মগধ জয় করেন এবং কিছুদিনের জন্য উত্তরবঙ্গে নিজের প্রভুত্ব বজায় রাখেন।
ত্রিশক্তি সংগ্রামের শেষ পর্ব : রাষ্ট্রকূট-রাজ তৃতীয় ইন্দ্র প্রতিহার-রাজ মহীপালকে পরাস্ত করে কনৌজ ত্যাগ করতে বাধ্য করেন। এই পরাজয়ের পর প্রতিহার সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয় এবং রাষ্ট্রকুটরা সাফল্য লাভ করে।
[৬] ত্রিশক্তি সংগ্রামের ফলাফল : (১) কনৌজকে কেন্দ্র করে প্রায় দুশাে বছর ধরে যে পাল, প্রতিহার ও রাষ্ট্রকূটদের মধ্যে ত্রি-শক্তি সংঘর্ষ হয়েছিল তাতে কেউই স্থায়ীভাবে কনৌজের ওপর একচ্ছত্র অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারে নি, উপরন্তু তিনটি রাজ্যই সামরিক দিক দিয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছিল।
(2) কনৌজ দখলের লড়াইয়ে সর্বদা ব্যস্ত থাকাবার ফলে তিনটি রাজ্যের অভ্যন্তরীণ শাসনব্যবস্থা দুর্বল হয়ে যায়।
(৩) দীর্ঘকালীন এই যুদ্ধের ব্যয়ভার বহন করতে প্রত্যেকেই অর্থনৈতিক দিক দিয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছিল।
(৪) শাসন ব্যবস্থার দুর্বলতার সুযােগে সামন্ত রাজারা বিদ্রোহ ঘােষণা করে। বারংবার বিদ্রোহের ফলে ভারতের রাজনৈতিক ঐক্য বিনষ্ট হয়ে গেলে তার পরিণতি হিসাবে ইসলাম শক্তির ভারত অভিযানের পথ প্রশস্ত হয়ে ওঠে।
No comments:
Post a Comment
Don't Leave any spam link.